SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

Admission
পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ১ম পত্র - পদার্থবিজ্ঞানের পরিসর ও বিস্ময়কর অবদান (Scope of Physics And Its Wonderful Contribution))

পদার্থবিজ্ঞানের পরিসর 

Scope of Physics

পদার্থবিজ্ঞান হলো বিজ্ঞানের চাবিকাঠি। অন্যান্য বিজ্ঞানের মৌলিক শাখা হলো পদার্থবিজ্ঞান। কারণ এর নীতিগুলোই বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাসমূহের ভিত্তি রচনা করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অণু-পরমাণু গঠন থেকে শুরু করে ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাষ পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞান বিস্তৃত। পঠন পাঠনের সুবিধার জন্য এবং পদার্থবিজ্ঞানকে বিশদভাবে আলোচনার জন্য তাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা-

(১) সাধারণ পদার্থবিজ্ঞান (General Physics)

(২) তাপবিজ্ঞান (Heat)

(৩) শব্দবিজ্ঞান (Sound) 

(৪) আলোকবিজ্ঞান (Light)

(৫) চুম্বকবিজ্ঞান (Magnetism) 

(৬) তড়িৎ বা বিদ্যুৎবিজ্ঞান (Electricity)

(৭) ইলেকট্রনিক্স (Electronics) 

(৮) পারমাণবিক বিজ্ঞান (Atomic Physics) ইত্যাদি।

সাধারণ পদার্থবিজ্ঞানকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা-

    (১) বলবিদ্যা (Mechanics) 

    (২) পদার্থের ধর্ম (Properties of matter)

বলবিদ্যা বস্তুর উপর বলের ক্রিয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন Bring আলোচনা করে। পদার্থের ধর্ম বস্তুর বিভিন্ন গুণ আলোচনা করে। বলবিদ্যা আবার দুই ভাগে বিভক্ত, যথা—

(১) স্থিতিবিদ্যা (Statics) এবং 

(২) গতিবিদ্যা (Dynamics)

স্থিতিবিদ্যা স্থিতিশীল বস্তুর উপর বলের ক্রিয়া আলোচনা করে এবং গতিবিদ্যা গতিশীল বস্তুর উপর বলের ক্রিয়া আলোচনা করে। গতিবিদ্যাকে পুনরায় দুই অংশে ভাগ করা হয়—সৃতিবিদ্যা ও চলবিদ্যা। 

পদার্থের কতকগুলো গুণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলোকে মিলিতভাবে পদার্থের ধর্ম (Properties of Matter) বলে। পদার্থের ধর্ম দুই প্রকার, যথা- 

(১) সাধারণ ধর্ম (General property) এবং

(২) বিশেষ ধর্ম (Special property)

যে ধর্ম সকল পদার্থেরই কম-বেশি রয়েছে তাকে পদার্থের সাধারণ ধর্ম বলে, যেমন ওজন, বিস্তৃতি, রোধ, স্থিতিস্থাপকতা ইত্যাদি। আর যে ধর্ম সকল পদার্থের নেই তাকে পদার্থের বিশেষ ধর্ম বলে, যেমন তারতা (Visco), পাততা, দৃঢ়তা, ভঙ্গুরতা ইত্যাদি ধর্ম কেবলমাত্র কঠিন পদার্থের বেলায় দেখা যায়। এসব ধর্ম কঠিন পদার্থের বিশেষ ধর্ম। সান্দ্রতা (Viscosity) তরল ও বায়বীয় পদার্থের বিশেষ ধর্ম। পৃষ্ঠটান বা তলটান (Surface Tension) তরল পদার্থের বিশেষ ধর্ম।

পদার্থবিজ্ঞানের পরিসর বা আওতা সুবিস্তীর্ণ। মানব সভ্যতার অগ্রগতির মূলে ইহা ভিত্তিপ্রস্তর স্বরূপ। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইহা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া এই মহাবিশ্ব সম্মন্ধে কোনো কিছু জানা আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব। অসীম আকাশ হতে শুরু করে প্রত্যেক পরমাণুর অভ্যন্তর পর্যন্ত এর পরিধি বিস্তৃত। যেখানেই বস্তু ও শক্তি রয়েছে সেখানেই পদার্থবিজ্ঞানের কিছু না কিছু করণীয় রয়েছে। সুতরাং সাধারণ শিক্ষার বাহক হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানের সেবায় ব্রত হওয়া প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। পদার্থবিজ্ঞানের ব্যাপকতা এবং এর ব্যবহার মানবকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

📝 বিস্ময়কর অবদান

Wonderful Contribution

মানব কল্যাণে পদার্থবিজ্ঞানের অবদান অপরিসীম। বিভিন্ন শক্তি হতে দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রভূত আরাম- আয়েশ পেয়ে থাকি। একমাত্র বিদ্যুৎ শক্তি এত প্রকার কার্যে ব্যবহৃত হয়েছে যে, আধুনিক যুগকে বৈদ্যুতিক যুগ বললেও অত্যুক্তি হয় না। বৈদ্যুতিক পাখা, বৈদ্যুতিক বাতি, বৈদ্যুতিক চুল্লি, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, টেলিভিশন, কম্পিউটার, রেডিও, মোটর, বিদ্যুচ্চালিত টেন, বিদ্যুচ্চালিত কল-কারখানা সবই বিদ্যুতের অবদান। বাষ্পীয় ইঞ্জিন, পেট্রোল ইঞ্জিন এবং তৈল ইঞ্জিন হতে আমরা যে তাপ শক্তি পাই তা বিভিন্ন কার্যে প্রয়োগ করি। বায়ুর চাপ মাপার জন্য ব্যারোমিটার, ঊষ্ণতা মাপার জন্য থার্মোমিটার, বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ মাপার জন্য আমরা হাইগ্রোমিটার নামক যন্ত্র ব্যবহার করি। আলোকবিজ্ঞানে আমরা চশমা, অণুবীক্ষণ যন্ত্র, দূরবীক্ষণ যন্ত্র, ক্যামেরা প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকি। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, যথা- হারমোনিয়াম, বাঁশি, ঢাক, ঘণ্টা, পিয়ানো, গ্রামোফোন, বেহালা, এসরাজ, সেতার প্রভৃতি যন্ত্র দ্বারা আমরা বিশেষভাবে উপকৃত হই। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হাইড্রলিক প্রেস, বিভিন্ন পাম্প, তুলাযন্ত্র, ঘড়ি, দোলক, লিভার, ক্রেন, পুলি প্রভৃতি যন্ত্রের বহুল ব্যবহার রয়েছে। রিয়্যাক্টর নামক যন্ত্রের সাহায্যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে যে প্রচুর শক্তি পাওয়া যায় সেই শক্তিকে বিভিন্ন শিল্পে এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রয়োগ করা হয়। এছাড়াও বিশ্লিষ্ট এই যন্ত্র পারমাণবিক বোমা প্রস্তুতে ব্যবহৃত হয়। মানুষ আজ রকেট চালিত মহাকাশযানে চড়ে চন্দ্রে এবং গ্রহান্তরে পাড়ি দিচ্ছে। এসবই বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার।

বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যই মানুষ পেয়েছে গুহার পরিবর্তে আধুনিক বাড়ি-ঘর, পার্থিব আরাম-আয়েশ ও জীবনের নিরাপত্তা। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে মানুষ দূরকে করেছে নিকট, প্রকৃতিকে করেছে বর্ণীভূত এবং অসম্ভবকে করেছে সম্ভব। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ এবং নিরাপত্তার জন্য মানবজাতি বিজ্ঞানের কাছে ঋণী। বিজ্ঞানের কল্যাণে 10 মিটার আকৃতির মৌলিক কণাসহ 100 মিটার দূরত্বের আকাশ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। অতএব আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের বিজ্ঞান সাধনাকে সাধারণ শিক্ষার প্রধান বাহন হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।

📚 ১.৩ পদার্থবিজ্ঞানে ধারণা, সূত্র, নীতি, স্বীকার্য, অনুকল্প এবং তত্ত্ব-এর অর্থ 

(Meaning of Concept, Law, Principle, Postulates, Hypothesis and Theory in Physics) 

বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক চিন্তা-ভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কীভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে তা বুঝাবার জন্য একটি মনোজ্ঞ উদাহরণ দেওয়া হলো। মনে করি, একটি ছেলে বাড়ি হতে হারিয়ে। গিয়েছে। গৃহস্বামী এই সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই অস্থির হয়ে উঠবেন এবং জল্পনা-কল্পনা করতে শুরু করবেন। প্রথমেই তিনি মনে করবেন যে ছেলেটি কোনো প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়েছে। এটা তদন্ত করবার জন্য তিনি প্রতিবেশীর বাড়িতে যাবেন। কিন্তু ছেলেটিকে যদি প্রতিবেশীর বাড়িতে পাওয়া না যায় তবে তিনি ধরে নিবেন যে তাঁর অনুমান মিথ্যা এবং তিনি এই অনুমান পরিত্যাগ করবেন। মনে করি, ঠিক ঐ সময়ে জনৈক ভদ্রলোক গৃহস্বামীকে জানালেন যে, ছেলেটিকে 'X' নামক রাস্তায় দেখা গিয়েছে। তখন গৃহযামী ধরে নিবেন যে, তাঁর ছেলে হারিয়ে যায়নি বরং ছেলেটি 'X' নামক রাস্তায় গিয়েছে। তখন তিনি ছেলেটির সন্ধানে X নামক রাস্তায় যাবেন। যাবার পর তিনি দেখলেন যে 'X' নামক রাস্তাটি দুটি রাস্তায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। মনে করি, একটি 'Y' এবং অপরটি 'Z'। এখন তাঁর নিকট দুটি সম্ভাবনা দেখা দিবে। ছেলেটি দুটি রাস্তার যে কোনো একটি রাস্তায় যেতে পারে। ছেলেটি কোন রাস্তায় গিয়েছে এর সত্যতা নিরূপণের জন্য ঐ জায়গায় তদন্তের প্রয়োজন। তদন্তের পর দেখা গেল যে, ছেলেটি 'Z' নামক রাস্তায় গিয়েছে। এখন গৃহস্বামীর ধারণা ছেলেটি হারিয়ে যায়নি। সে 'X' নামক রাস্তা হয়ে 'Z' নামক রাস্তায় গিয়েছে। ছেলেটিকে পাবার জন্য তিনি '2' নামক রাস্তায় যাবেন। মনে করি, 'Z' নামক রাস্তাটি আবার তিনটি রাস্তায় বিভক্ত হয়ে গেছে। সেগুলো হলো 'P', 'Q' এবং 'R"। ছেলেটি কোন রাস্তায় গিয়েছে তা জানার জন্য আরও তদন্তের প্রয়োজন। এভাবে ছেলেটি সম্পর্কে আমরা ক্রমাগত জানতে পারি এবং আমাদের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকবে। অনুরূপভাবে বলা যেতে পারে যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জল্পনা-কল্পনা, চিন্তা-ভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে।

ধারণা বা প্রত্যয় (Concept) :

কোনো কিছু সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি বা বোধগম্যতা হলো ঐ বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। যেমন তাপের ধারণা হলো— তাপ একপ্রকার শক্তি যা কোনো বস্তুতে প্রয়োগ করলে বা বস্তুটিকে গরম করলে বস্তুটির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং বর্জন করলে তাপমাত্রা হ্রাস পায়।

সূত্র (Law) : 

যখন কোনো তত্ত্ব অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণিত হয় এবং এর মূল কথাগুলি একটি উক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে বৈজ্ঞানিক সূত্র বলা হয়। সূত্র অনেক সময় আবিষ্কর্তার নামানুসারে; যেমন ও'মের সূত্র, বয়েলের সূত্র: কখনওবা বিষয়ের নামে যেমন শক্তির নিত্যতা সূত্র, তাপগতিবিদ্যার সূত্র; আবার কখনও আবিষ্কারক এবং বিষয় উভয়ের নামে হয়ে থাকে, যেমন নিউটনের গতিসূত্র, গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তুর সূত্র। 

মূলনীতি (Principle) : 

যে সকল প্রাকৃতিক সত্য সরাসরি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করা যায় এবং ঐ সত্যের সাহায্যে অনেক প্রাকৃতিক ঘটনাকে প্রমাণ করা যায়, তাকে নীতি বলে। যেমন ডপলারের নীতি, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি ইত্যাদি।

স্বীকার্য (Postulates ) : 

কোনো গাণিতিক মডেল বা সূত্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে যদি কিছু পূর্বশর্ত স্বীকার করে নেওয়া হয়, তবে ঐ পূর্বশর্তসমূহকে স্বীকার্য (Postulates) বলে। যেমন— বিখ্যাত বিজ্ঞানী নীলস বোর (Neils Bohr) পরমাণু মডেল প্রদানের জন্য দুটি স্বীকার্য গ্রহণ করেন। আবার বিজ্ঞানী আইনাস্টাইন আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব প্রবর্তন করেন যা দুটি মৌলিক স্বীকার্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।

অনুকল্প (Hypothesis) : 

বিজ্ঞানীরা তাঁদের পর্যবেক্ষিত ঘটনার কারণ সম্মন্ধে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য অনেক সময় পূর্বে আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সামজস্য রেখে কিছু অনুমান করেন। এই অনুমানগুলোকে বলা হয় অনুকল্প। অনুকল্পগুলো পর্যবেক্ষিত ঘটনার প্রাথমিক ব্যাখ্যা প্রদান করে। অনুকল্পগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা সম্পাদন করা হয় এবং পরীক্ষায় সত্য প্রমাণিত হলে তা তত্ত্বে পরিণত হয়। পরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণ দ্বারা অনুকল্প সমর্থিত হতেও পারে, আবার বাতিলও হতে পারে। তবে কিছু কিছু অনুকল্প আছে যা প্রমাণিত হওয়ার পরেও অনুকল্প হিসেবে এখনও পরিচিত। যেমন অ্যাভোগেড্রোর অনুকল্প (Avogadro's hypothesis) |

তত্ত্ব (Theory) : 

অনুকল্প ও নিয়মের সমন্বয়ে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত অনুকল্পকে তত্ত্ব বলে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাহায্যে প্রকৃতিকে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যখন কোনো তত্ত্বকে কিছু ধারণা বা উক্তি এবং সমীকরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়, তখন সেই তত্ত্বকে সূত্র বলে। সুতরাং সকল সূত্রই তত্ত্ব, তবে সকল তত্ত্ব সূত্র নয়। আবার সকল তত্ত্বই অনুকল্প এবং সকল অনুকল্প তত্ত্ব নয়। তত্ত্ব সাধারণত আবিষ্কর্তার নামানুসারে অথবা বিষয়ের সাথে সংগতি রেখে নামকরণ করা হয়। যেমন আইনস্টাইনের আপেক্ষিক, তত্ত্ব, কোয়ান্টাম তত্ত্ব ইত্যাদি।

📚 ১.৪ পদার্থবিজ্ঞান ও অন্যান্য জ্ঞানের জগৎ 

( Physics and other Scientific World)

পদার্থবিজ্ঞানের সাথে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সম্পর্ক :

 পদার্থবিজ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার ভিত্তি। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার উন্নয়নে পদার্থবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রাবলি বিজ্ঞানের নতুন শাখার উদ্ভব ঘটিয়েছে যাকে আমরা জীবপদার্থবিদ্যা বলতে পারি। Mechanical, nuclear, gravimetric এবং acoustics পদ্ধতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে ভূতত্ত্ববিদ্যা, পরিমাপন বিদ্যা, সমুদ্র গবেষণা ও ভূকম্পবিদ্যায় ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সুতরাং বলা যায় মানবজাতির উন্নতি এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে পদার্থবিজ্ঞানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে বিভিন্ন বিজ্ঞান এবং সাহিত্য সংস্কৃতি, সমাজবিজ্ঞানসহ দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাব আলোচনা করা হলো।

রসায়ন :

পরমাণুর গঠন, তেজস্ক্রিয়তা, এক্স-রে বর্তমান রসায়ন শাস্ত্রোর জগতে বিপ্লব সূচনা করেছে। এই সমস্ত গবেষণা মৌলের পর্যায় সারণিতে পুনর্বিন্যাস ঘটিয়েছে, নমুনা বস্তুর গতি নির্ণয় করেছে, ভ্যালেন্সির প্রকৃতি এবং রাসায়নিক বন্ধন সম্বন্ধে অবহিত করেছে। ইহা জটিল রাসায়নিক গঠন জানতে সহায়তা করে।

গণিতশাস্ত্র : 

পদার্থবিজ্ঞান হচ্ছে তাত্ত্বিক বিজ্ঞান। পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলি গাণিতিক ধারণার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের উন্নয়নে গণিতশাস্ত্র শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে আসছে।

জীববিদ্যা :

জীববিদ্যায় পদার্থবিজ্ঞানের ভূমিকা অপরিসীম। জীববিদ্যা অধ্যয়নে মাইক্রোস্কোপের ব্যবহার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে কোষের গঠন জানা অনেক সহজ হয়েছে। কোষের গঠন জানতে ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপ অনেকটা সম্ভবপর করে তুলেছে। X-Ray এর ব্যবহার নিউক্লিক এসিডের গঠন জানতে সহায়তা করে যা জীবনকার্যের মূল প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

জ্যোতির্বিদ্যা :

জ্যোতির্বিদ্যা সম্পৰ্কীয় টেলিস্কোপ গ্যালিলিওকে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী সম্পর্কে জানতে সহায়তা করেছিল। বিভিন্ন দেশের মানমন্দিরে বড় বড় টেলিস্কোপ স্থাপন করে সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ সম্মন্ধে আমরা জ্ঞানার্জন করতে পারি। রেডিও টেলিস্কোপের ব্যবহার Quasars এবং Pulsars আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং ইহা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করতে সহায়তা করেছে। পদার্থবিজ্ঞানের উন্নত চিত্রগ্রহণ পদ্ধতি জ্যোতির্বিদ্যার জগতে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।

প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখা : 

প্রযুক্তি কীভাবে তোমার জীবনকে প্রভাবিত করে তা খেয়াল কর। সকালে ঘুম থেকে উঠা হতে শুরু করে ব্রাশ করা, গোসল করা, রান্না করা, খাওয়া, কলেজে যাওয়া, গাড়িতে উঠা, রাতে বাতি জ্বালিয়ে পড়াশুনা করা, কলম দিয়ে খাতায় লেখা, জ্বর মাপা, ঘড়ি দেখা, রেডিও-টিভিতে খবর শুনা সবকিছুই হলো প্রযুক্তি। এছাড়া কৃষকের জমি চাষ করে ফসল ফলানো, বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয় নানা রকমের প্রযুক্তি। তাই বলা যায়, প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। আধুনিক প্রযুক্তির মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রযুক্তি হলো তথ্য প্রযুক্তি। এই সকল প্রযুক্তিকে সুশৃঙ্খল ও সমৃদ্ধ করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন শাখায় বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন তথ্য প্রযুক্তি, কৃষি প্রযুক্তি, চিকিৎসা প্রযুক্তি, মহাকাশ প্রযুক্তি ইত্যাদি।

প্রযুক্তি সাধারণত সাধারণ বিজ্ঞান কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল। পদার্থবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিজ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ শিল্পের উন্নয়নে এবং মানবের জীবন-মানের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ফ্যারাডে কর্তৃক আবিষ্কৃত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইনডাকশন এক অভূতপূর্ব আবিষ্কার যা শুধু মানুষের উন্নয়নই ঘটায়নি; বরং তা প্রযুক্তির মূল ভিত্তি। স্টিম ইঞ্জিন জেনারেটর, মোটরের আবিষ্কার শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেছে। দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিসরে তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের জ্ঞান রেডিও, টেলিভিশন, বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন দেশের অনুষ্ঠান টিভির পর্দায় সরাসরি দেখতে পাই। এ ধরনের স্যাটেলাইট আবহাওয়ার পূর্বাভাষ দিতে সক্ষম। তাছাড়া ভূতাত্ত্বিক জরিপ (Geophysical Survey) এবং তেলের খনি আবিষ্কার করতে সহায়তা করে।

আমরা গৃহে ও শিল্প কারখানায় যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকি তা বিভিন্ন প্রকার শক্তির রূপান্তরের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে তাপ শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়।

জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানির বিভব শক্তিকে ব্যবহার করে যান্ত্রিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। নিউক্লিয় পারমাণবিক চুল্লীতে ফিশন মিথস্ক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট নিউক্লিয় শক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এগুলোসহ পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রয়োগ প্রযুক্তিক্ষেত্রে উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সুতরাং পদার্থবিজ্ঞান প্রযুক্তির জগতে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিরাট অবদান রাখছে।

চিকিৎসাবিজ্ঞান :

আধুনিক চিকিৎসা যেমন মানবজীবন রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করছে তেমনি পদার্থবিজ্ঞানের উদ্ভাবিত নানাবিধ যন্ত্র সঠিক রোগ নির্ণয়ে দীর্ঘদিন অবদান রেখে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফ, সিটিস্ক্যান, এম আর আই, ইসিজি, এন্ডোসকোপি, রেডিওথ্যারাপি, ইটিটি, এনজিওগ্রাফি ও আইসোটোপ ব্যবহার করে চিকিৎসকগণ তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হচ্ছে। চিত্র ১১ এ এক্স-রে ও ইসিজি মেশিন দেখানো হলো। রোগ নির্ণয়ে X-Ray ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি প্রদান করা হয় এবং এতে রেডিও আইসোটোপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

চিত্র : ১.১

কৃষিবিজ্ঞান : 

প্রযুক্তি মানব সভ্যতার মতোই পুরানো। যখন থেকে সভ্যতার ইতিহাস লেখা হচ্ছে তার আগে থেকেই প্রযুক্তির ব্যবহার চলে আসছে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাদ্য। প্রকৃতিতে যেসব উদ্ভিদ ও প্রাণী সহজাতভাবে জন্মে ও বৃদ্ধি পায় তা মানুষ এক সময় ব্যবহার করেছে। উদ্ভিদ, গাছের ফল, প্রাণীদের মাংস খাদ্যরূপে মানুষ গ্রহণ করেছে শত শত বছর ধরে। পরবর্তীতে যাযাবর জীবনের অবসান ঘটিয়ে মানুষ যখন খাদ্য উৎপাদন ও পশুপালন শুরু করল তখনই কৃষি সভ্যতার শুরু।

কৃষি প্রযুক্তিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এলো দুটো কারণে। একটি হলো উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন কীভাবে উদ্ভিদ সূর্যের আলো থেকে শক্তি নিয়ে এবং মাটি, পানি ও বাতাস থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান নিয়ে খাদ্য উৎপাদন করে। অন্যটি হলো নতুন সব কৃষি যন্ত্রের উদ্ভাবন ও কৃষিকাজের যান্ত্রিকীকরণ। এর ফলে কৃষির ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে যাকে কৃষি বিপ্লব বলা যায়। এই সকল উদ্ভাবিত সকল যন্ত্রপাতি হলো পদার্থবিজ্ঞানের অবদান। চিত্র ১.২ এ কয়েকটি কৃষি যন্ত্রপাতি দেখানো হলো।

সাহিত্য ও সংস্কৃতি :

 সাহিত্য ও সংস্কৃতি সভ্য জাতিসত্তার একটি উল্লেখযোগ্য দিক। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা মানব সমাজকে সত্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এরই আওতায় পদার্থবিজ্ঞান নানাভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কবিতা পাঠে, শব্দের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে, মাইক্রোফোনের সাহায্যে কথা বলা থেকে শুরু করে গান-বাজনা চর্চায় ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রসহ নানাবিধ পদার্থবিজ্ঞানের উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশল।

সমাজবিজ্ঞান : 

পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন আবিষ্কার মানব কল্যাণ এবং উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। পদার্থবিজ্ঞানের সাথে সমাজ জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানের জগতের যে কোনো আবিষ্কার সমাজকে প্রভাবিত করে। পদার্থবিজ্ঞানের যে কোনো প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করেছে। পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কার যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। উদাহরণস্বরূপ- টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, টেলিপ্রিন্টার, টেলেক্স, ই-মেইল, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বের সাথে অতি অল্প সময়ে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হচ্ছি। রেডিও ও টেলিভিশন আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দ্রুততর করেছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলসমূহ আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা করেছে। বিশ্বের কোথায় কি ঘটেছে বা ঘটছে তা আমরা মুহূর্তের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। Microelectronics, lasers এবং কম্পিউটার মানবের চিন্তনে এবং জীবন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন সাধন করেছে।

দর্শন :

মানুষের আচার-আচরণ নির্ভর করে তার ব্যক্তিসত্তা ও কর্মকাণ্ডের উপর। মানুষ প্রকৃতির দাস। সে যে আচরণ অন্যের কাছ থেকে পেয়ে থাকে অপরকেও তদ্রুপ দেওয়ার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। মানুষের মেধা ও মনন যদি কোনো কারণে থেমে যায় বা বাধাগ্রস্ত হয় তা অন্য কোনো কর্মকাণ্ডে অন্যভাবে প্রতিফলিত হয় এবং তার মেধা, মনন ও প্রতিতার কোনো ঘাটতি ঘটে না। এদিক দিয়ে উক্ত তথ্যটি পদার্থবিজ্ঞানের ভরবেগের নিত্যতার সুরের সাথে একাত্ম হয়ে আছে। এভাবে চলমান জীবনে নানা ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

খেলাধুলা :

খেলাধুলা শরীর ও মনকে সতেজ করে। সুশৃঙ্খল ও নিয়মমাফিক খেলাধুলায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামানি এবং আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি শুধু খেলার মানকেই বৃদ্ধি করে না বরং শরীর চর্চায় নানাবিধ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। যেমন ফ্লাশলাইট ব্যবহার করে রাতে আমরা খেলা উপভোগ করি, সময় নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ধরনের টাইমার ব্যবহার করি, ফলাফল প্রদর্শনের জন্য কোরবোর্ড ব্যবহার করি, গতি মাপার জন্য লিডোমিটার ব্যবহার করি। এছাড়া খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত নানা ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের সকল প্রযুক্তি খেলার জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে।

 

Content added || updated By